Friday, March 28, 2014

মন : শক্তি রহস্য

মন কি? মনের শক্তির উৎস কোথায়? এক কথায় এর জবাব দেয়া মুশকিল। কারণ মনকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। আজ পর্যন্ত কোন বিজ্ঞানী মনকে ধরতে বা ছুঁতে পারেন নি বা কোন ল্যাবরেটরিতে টেস্ট টিউবে ভরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারেন নি। তবে মনের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে আদি যুগের সাধকরা যেমন সচেতন ছিলেন তেমনি বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরাও সচেতন। হাজার বছরের পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তারা একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তা হলো, মন মানুষের সকল শক্তির উৎস। মনের এই শক্তি-রহস্যকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারলেই এই শক্তিকে আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারব।
মনের শক্তি-রহস্য উন্মোচনের আগে মানুষ সম্পর্কে আমাদের ধারণাটা একবারপর্যালোচনা করা দরকার। এক সময় বিজ্ঞান মনে করত মানুষ হচ্ছে বস্ত্তর সমষ্টি যা কোন না কোন ভাবে চিন্তা করতে শিখেছে। আর এখন বিজ্ঞান মনে করে মানুষ চেতনা বা তথ্যের সমষ্টি যাকে কেন্দ্র করে দেহ গঠিত হয়েছে। মানুষ সম্পর্কে বিজ্ঞানের ধারণা পরিবর্তনের মূলে রয়েছে জেনেটিক গবেষণায় অভাবনীয় অগ্রগতি। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সমস্ত প্রাণীর বিকাশের মূল নিহিত রয়েছে জেনেটিক কোড তথা ডিএনএ-তে (ডিএনএ=ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড)। প্রতিটি জীব-কোষের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে এই ডিএনএ। প্রাণের বিকাশ কিভাবে ঘটবে তার সবটাই লিপিবদ্ধ আছে এই ডিএনএ-তে। গাছপালা, পশু-পাখি, ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস, সবকিছুর প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে ডিএনএ। মানব দেহের বিকাশের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে, মাতৃগর্ভে একটি ডিম্ব এবং একটি শুক্রকীটের মিলনের পর ডিম্বের ডিএনএ ও শুক্রকীটের ডিএনএ মিলে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন ডিএনএ। এই ডিএনএ কোডেই লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে পর্যায়ক্রমে তা কিভাবে পূণাঙ্গ মানব-শিশুতে পরিণত হবে এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কিভাবে শরীরের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। ভাবলে অবাক হতে হয়, এই ডিএনএ নিজে নিজে ভাগ হয়ে ক্রমাগত জীবকোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমন কি ব্রেনের মত জটিল অঙ্গ তৈরি করছে। পূর্ণাঙ্গ শিশুতে পরিণত হয় ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর দেহ-মনকে সর্বাঙ্গীনভাবে বিকশিত করে নিজে নিজেই নিজের সবকিছু পরিচালিত করছে। এক কথায় ডিএনএ-একে বলা যায় প্রাণের ব্লু প্রিন্ট।
ডিএনএ-কে ব্যাখ্যা করার জন্যে আমরা একটি গাড়িকে উদাহরণ হিসেবে ধরতে পারি। ধরুন, আপনি বাজার থেকে একটি গাড়ির ব্লু-প্রিন্ট কিনে এনে গ্যারেজে রেখে দিলেন। এবার কল্পনা করুন, ব্লু-প্রিন্টটি নিজে নিজে আস্তে আস্তে গাড়ির ইঞ্জিন তৈরি করল, গাড়ির বডি তৈরি করল, সিট ও সিট কভার তৈরি করল, ড্রাইভিং প্যানেল, চাকা, উইন্ডশিল্ড ইত্যাদি তৈরি করে গাড়িতে রঙ স্প্রে করে চকচকে ঝকঝকে করে ফেলল। তারপর পেট্রোল ট্যাঙ্কি তৈরি করে পেট্রোল ভরে নিজে নিজেই চলা শুরু করল। এই ধারণা বুঝতে ও উপলব্ধি করতে পারলেই প্রাণের বিকাশে ডিএনএ-র ভূমিকা উপলব্ধি করা সম্ভব।
ডিএনএ-র গঠন সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা যায়: এটি পর্যবেক্ষণ করতে ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ-এর প্রয়োজন। দেখতে প্যাঁচানো সিঁড়ির মত। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ও ডিএনএ বিশেষজ্ঞ ড. জন কেনড্রু বলেছেন, ‘এটি জীব কোষের নিউক্লিয়াসে টেপের মত প্যাঁচানো থাকে। ডিএনএ টেপকে সোজা করা হলে তা এক মিটার লম্বা হবে। মানব দেহে এই ডিএনএ-র কাজের সংখ্যা সাত লক্ষ। একটি সেলের ডিএনএ-তে যে তথ্য রয়েছে তাকে ভাষান্তর করে লিপিবদ্ধ করতে এক হাজার খন্ড বিশ্বকোষ লাগবে।মানব দেহের ৫০ থেকে ৭০ ট্রিলিয়ন সেলের প্রতিটিতেই রয়েছে ৩ বিলিয়ন জেনেটিক বিট এর পুরো সেট। প্রতিটি সেলের ডিএনএ-ই একটি অপরটির কার্বন কপি। ব্রেন নিউরোন এবং ত্বকের সেল জেনেটিকভাবে একই। একই ডিএনএ থেকে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও তাদের কাজ ও আয়ুষ্কাল ভিন্ন। একই ডিএনএ দুর্বোধ্য পন্থায় শরীরের সকল ধরনের সেল যথা হাড়, লিভার, কিডনি, হার্ট প্রভৃতির সেল নির্মাণ করছে। আর এ সেলগুলোর প্রতিটির নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল রয়েছে। শুধুমাত্র সেলের দিকে তাকিয়ে এর আয়ুষ্কাল বলা যায় না। যেমন ব্রেনের নিউরোন এবং নাকের ওলফ্যাক্টরি সেল দেখতে একই রকম। কিন্তু নিউরোনের আয়ু বহু বছর হলেও ওলফ্যাক্টরি সেল পরিবর্তিত হয় ৪ সপ্তাহে।
প্রতিটি সেল বিভিন্ন পরমাণু দ্বারা গঠিত যা কার্যত উড়ে বেড়ায়। ফুসফুসে অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড বদল হতে লাগে এক সেকেন্ডের হাজার ভাগের কয়েকভাগ সময়। ব্রেন নিউরোন থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৩০০ বার সোডিয়াম ও পটাশিয়াম আয়ন পাম্প করে ঢোকানো ও বের করা হয়। রক্ত থেকে অক্সিজেন শোষণ করতে হার্ট মাসলের সময় লাগে কয়েক সেকেন্ড মাত্র। নদীর মত আপনার শরীরের সবকিছুই নিয়ত প্রবহমান। দেহের সবকিছুই বদলে যাচ্ছে। পাকস্থলীর আস্তর পরিবর্তিত হয় ৫ দিনে, ত্বক ৫ সপ্তাহে, রক্তের লোহিত কণিকা ৪ মাসে, হাড়ের সেল প্রতি ৩ মাসে, লিভার সেলের বদলাতে কয়েক বছর লাগে, ব্রেন সেল বদলায় না।
আপনার শরীরের অক্সিজেন, কার্বন, হাইড্রোজেন ও নাইট্রোজেনের প্রবাহ এত দ্রুত যে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আপনি পুরোপুরি নতুন হয়ে যেতেন। শুধু লোহা, ম্যাগনেশিয়াম ও তামার মত ভারী পদার্থ এই প্রক্রিয়াকে ধীর করেছে। তারপরও ক্যালিফোর্নিয়ার ওকরিজ ল্যাবরেটরিতে রেডিও আইসোটোপ পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে যে, প্রতিবছর আমাদের শরীরের শতকরা ৯৮ ভাগ এটম বা পরমাণু পরিবর্তিত হয়। কিন্তু এই ক্রমাগত বস্ত্তগত পরিবর্তন সত্ত্বেও আপনার দেহের কোন অঙ্গের আকার বা পরিচয় বা আপনার আকার বা পরিচয় কোন ভাবেই নষ্ট হয় নি। লিভার লিভারই রয়ে গেছে, পাকস্থলী পাকস্থলীই, কিডনি কিডনিই রয়ে গেছে। আর আপনি লক্ষ বছর ধরে সুস্পষ্ট মানব হিসেবেই রয়ে গেছেন। দেহের বস্ত্ত বা পদার্থ আসছে, যাচ্ছে, কিন্তু জেনেটিক স্তরে আপনি স্থায়ী। আপনার ডিএনএ-র মূল তথ্য কাঠামোয় কোন পরিবর্তন হচ্ছে না।
আর এই ডিএনএ তৈরি করেছে জৈব ঘড়ি। আর এই জৈব ঘড়িই নিয়ন্ত্রণ করছে জাগরণ, নিদ্রা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শরীরের তাপ, রক্তচাপ, যৌনতা ও বিভিন্ন হরমোনের প্রবাহে জোয়ার-ভাটায় প্রাণের সকল ছন্দ। হাইপো-থালামাসে অবস্থিত সুপ্রাচিয়াসমেটিক নিউক্লিয়াস নামে অভিহিত এক ক্ষুদ্র নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র চাকার ভেতরের চাকাকে নিয়ন্ত্রণ করে। দেহের ২৮ দিনের মাসিক ঋতুচক্র থেকে শুরু করে ৩ ঘণ্টা মেয়াদী প্রবৃদ্ধি হরমোন প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয় এই ক্ষুদ্র কেন্দ্র থেকে। এমনকি প্রতিটি জীবকোষ বা সেলের অভ্যন্তরে প্রতি সেকেন্ডে কয়েক হাজার বার যে রাসায়নিক ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়, তা-ও শরীরের এই মূল ঘড়ির ছন্দ ও নির্দেশনা অনুসরণ করে।
ডিএনএ-কে আপনি আরেক অর্থে বলতে পারেন আপনার জেনেটিক স্মৃতি ভান্ডার। আপনি এখন ঠান্ডা বা অন্য কোন রোগ থেকে নিরাময় লাভ করতে পারছেন, কারণ লক্ষ বছর আগে থেকে যে এন্টিবডি ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাস-এর সাথে যুদ্ধ করতে শিখেছে, সেই এন্টিবডির স্মৃতি ও তথ্য আপনার থাইমাস গ্ল্যান্ডে সংরক্ষিত আছে। আপনার ইমিউন সিস্টেম হচ্ছে, পূর্ব পুরুষরা যেসব রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তার প্রতিটির তথ্য সম্বলিত এক বিশ্বকোষ। জ্বর, প্রবাহ, প্লেগ ইত্যাদিতে হাজার হাজার প্রজন্মের মৃত্যুর ফলে লব্ধ তথ্যের বিশ্বকোষের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আপনার জীবন, আপনার প্রাণ।মানব দেহের ৫০ থেকে ৭০ ট্রিলিয়ন সেলের প্রতিটিতেই রয়েছে ৩ বিলিয়ন জেনেটিক বিট এর পুরো সেট। প্রতিটি সেলের ডিএনএ-ই একটি অপরটির কার্বন কপি। ব্রেন নিউরোন এবং ত্বকের সেল জেনেটিকভাবে একই। একই ডিএনএ থেকে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও তাদের কাজ ও আয়ুষ্কাল ভিন্ন। একই ডিএনএ দুর্বোধ্য পন্থায় শরীরের সকল ধরনের সেল যথা হাড়, লিভার, কিডনি, হার্ট প্রভৃতির সেল নির্মাণ করছে। আর এ সেলগুলোর প্রতিটির নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল রয়েছে। শুধুমাত্র সেলের দিকে তাকিয়ে এর আয়ুষ্কাল বলা যায় না। যেমন ব্রেনের নিউরোন এবং নাকের ওলফ্যাক্টরি সেল দেখতে একই রকম। কিন্তু নিউরোনের আয়ু বহু বছর হলেও ওলফ্যাক্টরি সেল পরিবর্তিত হয় ৪ সপ্তাহে।
প্রতিটি সেল বিভিন্ন পরমাণু দ্বারা গঠিত যা কার্যত উড়ে বেড়ায়। ফুসফুসে অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড বদল হতে লাগে এক সেকেন্ডের হাজার ভাগের কয়েকভাগ সময়। ব্রেন নিউরোন থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৩০০ বার সোডিয়াম ও পটাশিয়াম আয়ন পাম্প করে ঢোকানো ও বের করা হয়। রক্ত থেকে অক্সিজেন শোষণ করতে হার্ট মাসলের সময় লাগে কয়েক সেকেন্ড মাত্র। নদীর মত আপনার শরীরের সবকিছুই নিয়ত প্রবহমান। দেহের সবকিছুই বদলে যাচ্ছে। পাকস্থলীর আস্তর পরিবর্তিত হয় ৫ দিনে, ত্বক ৫ সপ্তাহে, রক্তের লোহিত কণিকা ৪ মাসে, হাড়ের সেল প্রতি ৩ মাসে, লিভার সেলের বদলাতে কয়েক বছর লাগে, ব্রেন সেল বদলায় না।
আপনার শরীরের অক্সিজেন, কার্বন, হাইড্রোজেন ও নাইট্রোজেনের প্রবাহ এত দ্রুত যে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আপনি পুরোপুরি নতুন হয়ে যেতেন। শুধু লোহা, ম্যাগনেশিয়াম ও তামার মত ভারী পদার্থ এই প্রক্রিয়াকে ধীর করেছে। তারপরও ক্যালিফোর্নিয়ার ওকরিজ ল্যাবরেটরিতে রেডিও আইসোটোপ পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে যে, প্রতিবছর আমাদের শরীরের শতকরা ৯৮ ভাগ এটম বা পরমাণু পরিবর্তিত হয়। কিন্তু এই ক্রমাগত বস্ত্তগত পরিবর্তন সত্ত্বেও আপনার দেহের কোন অঙ্গের আকার বা পরিচয় বা আপনার আকার বা পরিচয় কোন ভাবেই নষ্ট হয় নি। লিভার লিভারই রয়ে গেছে, পাকস্থলী পাকস্থলীই, কিডনি কিডনিই রয়ে গেছে। আর আপনি লক্ষ বছর ধরে সুস্পষ্ট মানব হিসেবেই রয়ে গেছেন। দেহের বস্ত্ত বা পদার্থ আসছে, যাচ্ছে, কিন্তু জেনেটিক স্তরে আপনি স্থায়ী। আপনার ডিএনএ-র মূল তথ্য কাঠামোয় কোন পরিবর্তন হচ্ছে না।
আর এই ডিএনএ তৈরি করেছে জৈব ঘড়ি। আর এই জৈব ঘড়িই নিয়ন্ত্রণ করছে জাগরণ, নিদ্রা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শরীরের তাপ, রক্তচাপ, যৌনতা ও বিভিন্ন হরমোনের প্রবাহে জোয়ার-ভাটায় প্রাণের সকল ছন্দ। হাইপো-থালামাসে অবস্থিত সুপ্রাচিয়াসমেটিক নিউক্লিয়াস নামে অভিহিত এক ক্ষুদ্র নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র চাকার ভেতরের চাকাকে নিয়ন্ত্রণ করে। দেহের ২৮ দিনের মাসিক ঋতুচক্র থেকে শুরু করে ৩ ঘণ্টা মেয়াদী প্রবৃদ্ধি হরমোন প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয় এই ক্ষুদ্র কেন্দ্র থেকে। এমনকি প্রতিটি জীবকোষ বা সেলের অভ্যন্তরে প্রতি সেকেন্ডে কয়েক হাজার বার যে রাসায়নিক ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়, তা-ও শরীরের এই মূল ঘড়ির ছন্দ ও নির্দেশনা অনুসরণ করে।
ডিএনএ-কে আপনি আরেক অর্থে বলতে পারেন আপনার জেনেটিক স্মৃতি ভান্ডার। আপনি এখন ঠান্ডা বা অন্য কোন রোগ থেকে নিরাময় লাভ করতে পারছেন, কারণ লক্ষ বছর আগে থেকে যে এন্টিবডি ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাস-এর সাথে যুদ্ধ করতে শিখেছে, সেই এন্টিবডির স্মৃতি ও তথ্য আপনার থাইমাস গ্ল্যান্ডে সংরক্ষিত আছে। আপনার ইমিউন সিস্টেম হচ্ছে, পূর্ব পুরুষরা যেসব রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তার প্রতিটির তথ্য সম্বলিত এক বিশ্বকোষ। জ্বর, প্রবাহ, প্লেগ ইত্যাদিতে হাজার হাজার প্রজন্মের মৃত্যুর ফলে লব্ধ তথ্যের বিশ্বকোষের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আপনার জীবন, আপনার প্রাণ।
প্রাণকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন আপনি? বস্ত্ত কিভাবে প্রাণে রূপান্তরিত হচ্ছে? প্রাণের বিকাশ সম্পর্কিত জটিল আলোচনায় না গিয়েও আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকেই একটা খুব সাধারণ বিষয় তুলে আনতে পারি। আর তা হচ্ছে দম। আপনি আপনার চারপাশের বায়ুমন্ডলে অবস্থিত অক্সিজেনের কথা ভাবুন। অক্সিজেন পরমাণু বাতাসে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাতাসের এই অক্সিজেন পরমাণু হচ্ছে বস্ত্ত। আর এই অক্সিজেন পরমাণুই দম নেয়ার সময় সেকেন্ডের হাজার ভাগের কম সময়ের মধ্যে ফুসফুসের প্রায় স্বচ্ছ পর্দা অতিক্রম করে রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হওয়ার সাথে সাথেই ‘জীবন্ত’ হয়ে ওঠে। হিমোগ্লোবিনের রং মুহূর্তে কালচে নীল থেকে উজ্জ্বল লাল রং-এ পরিবর্তিত হয়। বায়ুমন্ডলের একটি বিক্ষিপ্ত অক্সিজেন পরমাণু রূপান্তরিত হয় ‘আপনাতে’, এই পরমাণু অতিক্রম করে প্রাণ ও নিষ্প্রাণ বস্ত্তর অদৃশ্য সীমানা।
একবার দম নেয়ার সাথে সাথে কি পরিমাণ অক্সিজেন পরমাণু শরীরে প্রবেশ করে? প্রতিবার দম নেয়ার সাথে সাথে শরীরের ৫ ট্রিলিয়ন লোহিত কণিকা বাতাসের মুখোমুখি হয়। প্রতিটি রক্ত কণিকায় রয়েছে ২৮০ মিলিয়ন হিমোগ্লোবিন অণু। প্রতিটি হিমোগ্লোবিন অণু ৮টি করে অক্সিজেন পরমাণুকে ধরতে ও পরিবহন করতে পারে। প্রতিবার দমের সাথে ১১x১০২১ (১১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০, ০০০,০০০)টি অক্সিজেন পরমাণু শরীরে প্রবেশ করছে। এই অক্সিজেন পরমাণুকে শরীরের ‘ইট’ মনে করলে আমরা বলতে পারি যে, আমরা প্রতি দমের সাথে উপরিউক্ত সংখ্যক নতুন ‘ইট’ শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাগাচ্ছি। পুরাতন ‘ইটের’ বদলে একেবারে খাপে খাপে বসে যাচ্ছে নতুন ‘ইট’। পুরাতন নতুনের জন্যে জায়গা করে দিচ্ছে সহজে- ঠিক নদীর প্রবাহের মত।
শরীরের ভেতরে কত বিচিত্র তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছে মুহূর্ত আগের প্রাণহীন বস্ত্ত অক্সিজেন। সাধারণত ৬০ সেকেন্ডে আর ব্যায়ামকালে ১৫ সেকেন্ডে অক্সিজেন পরমাণু পুরো শরীর ঘুরে আসে একবার। এ সময়ের মধ্যে শরীরে প্রবেশকারী নতুন অক্সিজেনের অর্ধেক রক্ত থেকে বেরিয়ে কিডনি সেল, নিউরোন, পেশী সেল বা ত্বক সেলের অংশ পরিণত হচ্ছে। অক্সিজেন এটম সেল ভেদে কয়েক মিনিট থেকে এক বছর পর্যন্ত আপনার দেহে অবস্থান করতে এবং আপনি যা করতে সক্ষম তাতে সে পুরোপুরি অংশগ্রহণ করতে পারে। অক্সিজেন এটম একটি নিউরো-ট্রান্সমিটার-এর সাথে যুক্ত হয়ে আপনার একটি সুখকর চিন্তার অংশে পরিণত হতে পারে। আবার এড্রিনালিন অণুর অংশ হয়ে আপনার মধ্যে আতঙ্ক বিস্তার করতে পারে। গ্লুকোজের সাথে মিশে ব্রেন সেলের খাবারে পরিণত হতে পারে। আবার শ্বেত কণিকার অংশ হয়ে আক্রমণকারী ব্যাক্টেরিয়াকে প্রতিহত করতে গিয়ে আপনার জন্যে আত্মবিসর্জন দিতে পারে।
আর এসব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ডিএনএ-তে সংরক্ষিত তথ্য ভান্ডার দ্বারা। আমরা যদি আরও গভীরে যাই, আমরা দেখব এই ডিএনএ-ও প্রাথমিকভাবে কার্বন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন এটমের এক সূক্ষ্ম সমন্বয়। এক সূক্ষ্ম স্পন্দনের সুতোয় গাঁথা। এই সূক্ষ্ম স্পন্দনের সুতোই ডিএনএকে শক্তিশালী করেছে- এর যে কোন ব্যতিক্রম- এক মিলিমিটারের ১০ লক্ষ ভাগের একভাগ এদিক ওদিক হলেই এই সুতো ছিঁড়ে যাবে। আর জীবনের সব সূক্ষ্ম স্পন্দনের মূলে রয়েছে এক অন্তর্চেতনা।
জীবন ও প্রাণের এই প্রেক্ষাপটে আপনি যদি উপলব্ধি করতে পারেন চেতনা ও তথ্যের শক্তি কতখানি, তা হলে শক্তির আসল উৎসের সন্ধান পাবেন। মানুষের শক্তির আসল উৎস তার দেহ নয়, চেতনা। দেহ হচ্ছে এই চেতনার বাসস্থান। তাই এই চেতনার সঙ্গে যদি আমরা একাত্ম হতে পারি, চেতনাকে যদি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারি তা হলে দুটি ডিএনএ থেকে আমরা যেমন পরিপূর্ণ মানব দেহ লাভ করেছি তেমনি জীবনে পরিপূর্ণ সাফল্য লাভ করতে পারি। কারণ, মনের শক্তি এই চেতনারই একটা রূপ মাত্র। প্রতিভাবান আর সাধারণ মানুষের পার্থক্য এখানেই। প্রতিভাবানরা- সাধক, বিজ্ঞানী সফল মানুষেরা মনের এই শক্তিকে উপলব্ধি করেছেন, সৃজনশীলভাবে কাজে লাগিয়েছেন। ফলে তারা স্মরণীয়-বরণীয় হয়েছেন। আর সাধারণ মানুষ মনের এই শক্তি রহস্য সম্পর্কে সচেতন নয়; তাই তারা হতাশা নেতিচিন্তা ও রি-অ্যাকটিভ কাজকর্ম দ্বারা নিজেদের অনন্ত সম্ভাবনাকে নষ্ট করছে। এক কথায় বলা যায়, প্রতিভাবানদের সাফল্যের মূল রহস্য নিহিত রয়েছে মনের শক্তি সম্পর্কে সচেতনতা, মনের শক্তির উপর অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা এবং একাগ্রচিত্তে ক্রমাগত এই শক্তির সৃজনশীল প্রয়োগের মধ্যে।